কলকাতার ইতিহাসে Job Charnock নামটি সর্বদাই আলোচনায় থাকে। তাঁকে বলা হয় কলকাতার “প্রতিষ্ঠাতা”, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এক গোপন অধ্যায় আজও অনেকে জানেন না। ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন, জব চার্নকের স্ত্রী ছিলেন এক Hindu Brahmin widow, যাঁর নাম ছিল Leela (লীলা)। এই কাহিনি কেবল প্রেম ও সাহসিকতার নয়, বরং বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের নিদর্শন।
সতীদাহ থেকে উদ্ধার এক কিশোরী
১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে Patna (পাটনা) শহরে চাকরি করতেন জব চার্নক। তখন তাঁর কাজ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নুন ও মশলা সংগ্রহ করা। সেখানেই তিনি প্রত্যক্ষ করেন এক Sati system-এর ভয়ঙ্কর দৃশ্য। এক অল্পবয়সী কিশোরী বিধবাকে জোর করে জ্বলন্ত চিতায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল। চার্নক সাহস করে নিজের সৈন্যদের নিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন।
এই মেয়েটির নাম ছিল Leela, কাশীর বাসিন্দা এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তাঁর বাগদত্ত বৃদ্ধ স্বামীর মৃত্যুর কারণে তাঁকে “অনুমরণ” প্রথা অনুযায়ী সতীদাহের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু চার্নক তাঁকে বাঁচিয়ে নিজের আশ্রয়ে নেন।
সমাজের বিরোধিতা ও নবাবের রোষ
একজন English officer একজন হিন্দু বিধবাকে বাঁচিয়ে নিজের কাছে রাখায় তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। হিন্দু সমাজ তাঁকে চক্ষুশূল করে তোলে, এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারাও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবতে থাকেন। উপরন্তু, পাটনার নবাব অভিযোগ পান যে চার্নক এক Indian woman-কে বলপূর্বক রক্ষিতা বানিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত চার্নক বিপুল অর্থ ও উপঢৌকন দিয়ে নবাবকে শান্ত করেন। কিন্তু সামাজিক চাপের মধ্যেও তিনি লীলাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর লীলার নাম রাখা হয় Maria, তবে চার্নক তাঁকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেননি। বরং লীলার প্রভাবে চার্নক নিজেই হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
পারিবারিক জীবন ও কলকাতায় আগমন
বিয়ের পর বহু বছর তাঁরা সুখে সংসার করেন এবং তাঁদের কয়েকটি সন্তান জন্ম নেয়। ১৬৯০ সালে চার্নক পরিবার নিয়ে Calcutta (কলকাতা)-য় চলে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কিছুদিন পরেই লীলার মৃত্যু হয়।
চার্নক তাঁর স্ত্রীকে St. John’s Church Kolkata-র উত্তর-পূর্ব কোণের একটি সমাধিস্থলে সমাহিত করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চার্নকের কন্যা মেরি ও নাতির নাম সমাধিফলকে লেখা থাকলেও, লীলার নাম সেখানে নেই। ইতিহাসবিদদের মতে, চার্চ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবেই তাঁর নাম বাদ দিয়েছিলেন।
চার্নকাইট পাথরের রহস্য
জব চার্নকের সমাধি একটি বিশেষ পাথর দিয়ে তৈরি, যার নাম পরবর্তীতে রাখা হয় Charnockite stone। এই পাথর আনা হয়েছিল চেন্নাইয়ের সেন্ট থমাস মাউন্ট থেকে। আজও এই পাথর ভূতত্ত্ববিদদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
লীলার স্মৃতিতে অর্পণ
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, চার্নক প্রতি বছর স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর সমাধিতে একটি মোরগ উৎসর্গ করতেন। এটি ছিল একধরনের প্রতীকী ভালোবাসা, যা তাঁর ব্যক্তিত্বকে অন্য ইংরেজ শাসকদের থেকে আলাদা করেছিল।
জব চার্নকের উত্তরাধিকার
জব চার্নককে অনেকে “uncouth” বা রুক্ষ স্বভাবের ইংরেজ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর একাত্ম হওয়ার ক্ষমতা তাঁকে আলাদা করে তোলে। একজন British merchant হয়েও তিনি একজন Indian woman-কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যা সে সময়ের দৃষ্টিকোণে সাহসী ও ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ।
আজকের কলকাতার ইতিহাসে লীলা প্রায় বিস্মৃত, কিন্তু তাঁর নাম না জানলেও, তাঁর উপস্থিতি এই শহরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
কলকাতার সৃষ্টি ও বিকাশ কেবল রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক কারণে নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সংস্কৃতির মেলবন্ধন এবং সামাজিক প্রতিবাদের ওপরও দাঁড়িয়ে আছে। জব চার্নকের হিন্দু স্ত্রী Leela-র কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস কেবল তারিখ ও ঘটনা নয়, বরং মানুষের সাহস, ভালোবাসা ও ত্যাগের গল্পও।