সুহানা বিশ্বাস। কলকাতা সারাদিন।
রাজধর্ম পালন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বন্যা পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে ইট এবং পাথরের আঘাতে আহত হয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু। সাংসদ, বিধায়কের পাশাপাশি তাঁদের রক্ষীদেরও মারধরের অভিযোগ ওঠে। বর্তমানে এই দুজন ভর্তি রয়েছেন উত্তরবঙ্গের বেসরকারি হাসপাতালে। বিজেপির পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছিল তৃণমূলের পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু এবং বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষকে। যদিও তৃণমূলের পক্ষ থেকে বারে বারে দাবি করা হয়েছে এলাকার উত্তেজিত মানুষ আক্রমণ করেছিল তাঁদের। তবে এই চাপান উতোরের মধ্যেও হাসপাতালে গিয়ে আহত বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মুর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে তার চিকিৎসার বিষয়েও খোঁজ নিলেন মমতা।
এদিন দুপুরে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কথা বললেন চিকিৎসকদের সঙ্গে। উত্তরবঙ্গের ওই হাসপাতালে খগেন ও শঙ্কর দুই সাংসদ-বিধায়ক ভর্তি থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী শুধুমাত্র খগেন মুর্মুর সঙ্গেই দেখা করেন। বেরিয়ে জানান, সাংসদের অবস্থা এখন স্থিতিশীল রয়েছে। সোমবার নাগরাকাটায় দুর্গত এলাকায় গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু ও বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। বামনডাঙায় ঢোকার আগে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় তাঁদের। অতর্কিতে তাঁদের গাড়ি লক্ষ্য করে লাঠি, জুতো নিয়ে চড়াও হন অনেকে। গাড়ির পিছনের সিট থেকে নেমে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন খগেন মুর্মু। তখনই অতর্কিতে বিক্ষোভকারীদের ছোড়া ইট এসে লাগে তাঁর চোখের নীচে। চোখের নীচে গুরুতর আহত হন খগেন। রক্তাক্ত হন তিনি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চোখের নীচের হাড় ভেঙে গিয়েছে তাঁর। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, অস্ত্রোপচার করে মুখে পাত বসানো হতে পারে সাংসদের। পুত্র অনিমেশ মুর্মুর সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা হয়েছে চিকিৎসকদের। খগেন মুর্মু চোখের ঠিক নীচ থেকে নাকের নীচে পর্যন্ত বড় আঘাত। ভেঙেছে হাড়। সাতটা সেলাই পড়েছে। প্রথমে পাঁচটা সেলাই দেওয়া হয়। পরে অবস্থা বুঝে আরও দুটো সেলাই দেন চিকিৎসকরা। অস্ত্রোপচার করে পাত লাগানো জরুরি। অন্তত দিন পনেরো কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে সাংসদকে।
এই মুহূর্তে শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খগেন মুর্মু। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘খগেনের সঙ্গে কথা হয়েছে, অবস্থা স্থিতিশীল। খগেন মুর্মুর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।’ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানান, খগেন মুর্মুর ডায়াবেটিস রয়েছে, তার মাত্রাও বেশি। সেই দিকটা নজর রাখছেন চিকিৎসকরা। কানের নীচেও কিছুটা লেগেছে বলে জানান তিনি। মঙ্গলবার দুধিয়ায় ত্রাণ শিবিরে দুর্গতদের সঙ্গে দেখা করেন মমতা। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর যাওয়ার বিষয়টিতে খগেন মুর্মুর ছেলে অনিমেষ বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী না জানিয়ে হঠাৎ করে চলে এসেছেন। ওনার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই। ওনার লোকজনই তো হামলা চালিয়েছে।’ অন্যদিকে, এই নিয়ে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘নিজের ফেস সেভ করতে গিয়েছেন। সাংসদের ওপর রক্তাক্ত হামলা হয়েছে, এটা ভারতে বিরল। আর তারপরও ২৪ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, উনি পুলিশমন্ত্রী, ওনার পুলিশ একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেননি। ওনাকে মুখ রক্ষা করতে হবে, তাই গিয়েছেন।’ বিজেপি নেতা জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলায় এটা অস্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু সাংসদ আহত হলে মুখ্যমন্ত্রীর যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা! এটাকে অস্বাভাবিকত্ব নেই।’
অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মন্তব্য করছেন বলে বিস্ফোরক অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জলপাইগুড়ির নাগরাকাটায় সোমবার বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু এবং বিধায়ক শঙ্কর ঘোষের হামলার নিন্দা করে সোমবার রাতে এক্স হ্যান্ডলে বাংলা এবং ইংরেজিতে পোস্ট করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দুষেছিলেন রাজ্য সরকার এবং শাসকদল তৃণমূলকে। প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও নিজের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘এটি দুর্ভাগ্যজনক এবং গভীর ভাবে উদ্বেগজনক যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যথাযথ তদন্তের অপেক্ষা না করেই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রাজনীতিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশেষ করে যখন উত্তরবঙ্গের মানুষ ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধস পরবর্তী পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করছেন। প্রধানমন্ত্রী কোনও যাচাই করা প্রমাণ, আইনি তদন্ত বা প্রশাসনিক প্রতিবেদন ছাড়াই তৃণমূল কংগ্রেস এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সরাসরি দোষারোপ করেছেন। এটি কেবল নিম্নমানের রাজনীতির উদাহরণ নয়, এটি প্রধানমন্ত্রী যে সাংবিধানিক নীতি বজায় রাখার শপথ নিয়েছেন তার লঙ্ঘন। যে কোনও গণতন্ত্রে আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হয়। কেবলমাত্র আইনি প্রক্রিয়াই দোষী চিহ্নিত করতে পারে। কোনও রাজনৈতিক টুইট নয়। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর এই আকস্মিক উদ্বেগ সহানুভূতির চেয়ে বরং সুযোগ সন্ধানের জন্য রাজনৈতিক নাটকের মতো বলে মনে হচ্ছে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, নির্বাচিত রাজ্য সরকারের কথা শুনুন। কেবল আপনার দলের সহকর্মীদের কথা নয়। আপনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, কেবল বিজেপির নয়। আপনার দায়িত্ব জাতি গঠনের, আখ্যান গঠনের নয়। এই সংকটময় মুহূর্তে, আসুন আমরা বিভেদ আরও গভীর না করি। আসুন আমরা দলীয় লাইনের বাইরে ঐক্যবদ্ধ হই।’
আজ মমতা বলেন, ‘মানুষ মারা যাচ্ছেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, অথচ বলা হচ্ছে সেতু ভেঙে মৃত্যু হয়েছে। অন্য রাজ্যেও তো সেতু ভাঙছে। আমরা তো তা নিয়ে রাজনীতি করি না। কেউ কেউ রাজনীতি শুরু করে দিয়েছেন তখন বাংলায় কেন কার্নিভাল হল? আরে কার্নিভাল তো বাংলার গর্ব! বাংলার ক্লাবগুলো অপেক্ষা করে থাকে এর জন্য, তার কি কোনও মূল্য নেই? কোনও দুর্যোগের পর কাজ শুরু করতে ন্যুনতম সময় লাগে। সে দিন যদি আসতামও, এসে কী করতাম? ৪ তারিখ ভোর ৫টায় ডিজি এবং মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলাম। স্থানীয় স্বাস্থ্য ও জেলা আধিকারিকেরা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছিলেন। একটা দুর্যোগ ঘটে গেলে উদ্ধারকাজ শুরুর জন্য অন্তত ৪৮ ঘণ্টা সময় দিতে হয়।’ দুর্যোগ শুরুর দিন সকালেই উত্তরের জেলাগুলির প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক সারেন মমতা। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন তখনই।