প্রিয়াঙ্কা মান্না। কলকাতা সারাদিন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এমন এক নির্দেশ দিয়েছে যা দেশের গণতান্ত্রিক এবং বহুভাষিক কাঠামোকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। অভিযোগ উঠেছে যে, শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে বহু মানুষকে “বাংলাদেশি” সন্দেহে আটক করে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হচ্ছে অথবা জোরপূর্বক সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে Supreme Court observation on Bengali language arrest একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে সামনে এসেছে।
বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি সন্দেহ?
গত কয়েক মাস ধরে দেশের নানা রাজ্যে বিশেষ করে ডাবল ইঞ্জিন সরকার পরিচালিত রাজ্যগুলোতে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের দাবি, শুধু বাংলায় কথা বলার কারণেই তাদের বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হচ্ছে। কারও কারও ক্ষেত্রে এমনকি বিএসএফ পর্যন্ত হুমকি দিয়েছে—“পালাও না হলে গুলি করব।”
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে। সোনালী বিবি নামে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক মহিলাকে দিল্লি পুলিশ আটক করে এবং বাংলাদেশি সন্দেহে বিএসএফের সাহায্যে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। যদিও তাঁর পরিবার ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার মতো সমস্ত নথি জমা দেয়, তবুও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সেই প্রমাণ গ্রহণ করেনি।
সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ
এই ঘটনা কলকাতা হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলা আকারে আসে। কিন্তু কেন্দ্র দাবি করে, বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। পরে সমাজকর্মী ও আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ Supreme Court-এর তিন সদস্যের বেঞ্চে বিষয়টি উত্থাপন করেন।
বিচারপতি সূর্য কান্ত, বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এবং বিচারপতি বিপুল এম. পাঞ্চোলির বেঞ্চ স্পষ্টভাবে মন্তব্য করে—
ভারতের মতো বহুভাষাভাষী দেশে শুধুমাত্র ভাষার ভিত্তিতে কাউকে বিদেশি বলা যায় না।
পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবের মতো সীমান্ত রাজ্যে একই ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রয়েছে। শুধুমাত্র ভাষার কারণে কাউকে সন্দেহ করা অযৌক্তিক।
কেন্দ্রকে সাত দিনের মধ্যে জানাতে হবে, বিদেশি সন্দেহে কাউকে দেশ থেকে বের করার জন্য কী ধরনের প্রক্রিয়া ও নিয়মাবলী অনুসরণ করা হয়।
এই পর্যবেক্ষণ Supreme Court observation on Bengali language arrest হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।
কেন্দ্র সরকারের অবস্থান
কেন্দ্রের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা যুক্তি দেন যে, বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। তিনি আরও দাবি করেন, যদি কেউ ভুক্তভোগী হয় তবে তাদের সরাসরি মামলা করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, এর নেপথ্যে রাজ্য সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তবে আদালত এই যুক্তি সরাসরি খারিজ করে দেয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য— “বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা অন্যায়। আজকের নির্দেশে বাংলার অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকরা বড় ভরসা পেলেন। বিচারবিভাগ প্রমাণ করল, বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি ও শ্রমিকদের সম্মান রক্ষার জন্য আইন আছে।”
তিনি আরও বলেন, বাংলার শ্রমিকরা দেশের নানা প্রান্তে কাজ করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন। তাঁদের উপর অন্যায় আচরণ কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
কেন এই রায় গুরুত্বপূর্ণ?
1. পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষা: বাংলাভাষী শ্রমিকদের ভয় কমাবে।
2. বহুভাষার সম্মান রক্ষা: ভারতের সংবিধানে বহুভাষিক ঐতিহ্যের মর্যাদা আরও একবার নিশ্চিত হলো।
3. মানবাধিকারের সুরক্ষা: আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ আদালতের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ল।
4. কেন্দ্রকে জবাবদিহি: ভবিষ্যতে এই ধরনের আটক ও বিতাড়ন রোধে স্পষ্ট গাইডলাইন তৈরি করতে কেন্দ্র বাধ্য হবে।
Supreme Court observation on Bengali language arrest শুধু বাংলার মানুষের জন্য নয়, ভারতের সমস্ত ভাষাভাষীর জন্য এক ঐতিহাসিক বার্তা। ভাষা কোনও অপরাধ নয়, বরং পরিচয়, সংস্কৃতি ও আত্মমর্যাদার প্রতীক। আদালতের এই নির্দেশ ভারতীয় সংবিধানের বহুত্ববাদী চেতনা ও গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করল।
বাংলা বলার কারণে যদি কাউকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হয়, তবে তা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, দেশের ঐক্য ও সংহতির জন্যও হুমকি। তাই সুপ্রিম কোর্টের এই হস্তক্ষেপ শুধু আইনি নয়, নৈতিক বিজয়ও বটে।